খতিয়ান কি জমির মালিকানা প্রমাণ করে? জানুন আইনি বিশ্লেষণ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

-

খতিয়ান কি জমির মালিকানা প্রমাণে যথেষ্ট? দলিল ও খতিয়ানের পার্থক্য, আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমি আইনের আলোকে বিস্তারিত জানুন এই পোস্টে।

আলোচনার মূল বিষয়ে প্রবেশের পূর্বে আমাদের জানা প্রয়োজন—খতিয়ান বলতে কী বোঝায়। ‘খতিয়ান’ শব্দের সাধারণ অর্থ হলো হিসাব, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Record of Rights (RoR)। ভূমির দখল ও মালিকানার তথ্য সংরক্ষণ এবং সরকারের রাজস্ব আহরণ সহজতর করার জন্য ভূমি জরিপ অধিদপ্তর প্রতিটি মৌজার জমি সম্পর্কিত মালিকের নাম, ঠিকানা, অংশীদারিত্ব, দাগ নম্বর, পরিমাণ, শ্রেণি ও খাজনা ইত্যাদি বিবরণ সহ যে রেকর্ড প্রস্তুত করে, তাকেই খতিয়ান বলা হয়। সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী (ধারা ৭৪), খতিয়ান একটি সরকারি দলিল হিসেবে গণ্য হয়।

আলোচনাটি স্পষ্ট করতে নিচে একটি উদাহরণ দেওয়া হলো: ধরুন, “ক” নামক ব্যক্তি একটি রেজিস্ট্রেশন দলিলের মাধ্যমে একটি জমি ক্রয় করেন এবং সেই জমি তার নামে আর.এস খতিয়ানে নথিভুক্ত হয়। “ক” মৃত্যুর পর তার ছেলে “খ” ওয়ারিশ হিসেবে জমির মালিক হন। কিন্তু পরবর্তী খতিয়ানে দেখা গেল “খ” এর পরিবর্তে “গ” এর নামে জমি রেকর্ড করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, “গ” কি এই খতিয়ানের ভিত্তিতে জমির মালিকানা দাবি করতে পারবেন? অথবা, “খ” কি কোনো প্রতিকার পাবেন?

উত্তর হলো—”গ” খতিয়ানে নাম থাকলেও প্রকৃত মালিক না হওয়ায় তিনি জমির উপর মালিকানার অধিকার দাবি করতে পারবেন না। কেননা, খতিয়ান নিজে থেকে কারও মালিকানা সৃষ্টি করে না। বরং, “খ” যেহেতু ওয়ারিশ সূত্রে জমির প্রকৃত মালিক, তাই তিনিই আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে মালিক বিবেচিত হবেন।

মূল প্রশ্নে ফিরে গেলে বলা যায়, খতিয়ান কখনোই মালিকানা সৃষ্টি করতে পারে না। খতিয়ানে কারও নাম অন্তর্ভুক্ত হলে তা মালিকানা প্রমাণের সহায়ক হতে পারে, তবে তা একমাত্র মালিকানা নির্ধারণের ভিত্তি নয়। আবার, খতিয়ানে কারও নাম না থাকলে তার মালিকানা বাতিল হয়ে যায়—এমনটা নয়। খতিয়ান কেবল দখলের অন্যতম প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে এই ব্যাখ্যাটি সুস্পষ্ট হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, (59 D.L.R 60 D.LR 207) চান মাহমুদ বনাম হোসাইন আলী (৩ বিএলসি ৩৬৪) মামলায় আদালত মন্তব্য করেন, সি.এস খতিয়ান দখল বা মালিকানা সম্পর্কে অনুমান করতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু এটি মালিকানা তৈরি করতে পারে না। একইভাবে, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন বনাম সিলেট পৌরসভা (72 D.L.R 2020 HCD 181) মামলায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনোভাবে মালিক না হন, তবে কেবল খতিয়ানে নাম থাকার মাধ্যমে তিনি মালিকানা দাবি করতে পারবেন না।

অতএব, খতিয়ান, নামজারি, এবং খাজনার রশিদ ইত্যাদি দলিল দখল বা দখলদারিত্বের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু সেগুলোর মাধ্যমে মালিকানার জন্ম হয় না।

খতিয়ানে ভুল নাম থাকলে করণীয়
জরিপ কার্যক্রমের সময় অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত মালিকদের নাম খতিয়ানে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এর পেছনে নানা কারণ থাকে—যেমন মালিকের অনুপস্থিতি, নারীদের বিবাহজনিত কারণে অন্যত্র বসবাস, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে বঞ্চিত করার চেষ্টা। ফলে ভুলভাবে ভিন্ন ব্যক্তির নাম খতিয়ানে উঠে আসে।

এ ধরনের ভুল সংশোধনের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সাধারণত দুটি উপায়ে মামলা করা যায়:

১. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী ঘোষণা চেয়ে মামলা দায়ের করা যায়।
২. রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (S.A.T Act) এর ১৫৪(ক) ধারা অনুযায়ী ভূমি জরিপ ট্রাইবুন্যালে সংশোধনের আবেদন করা যায়।

LawyerClue
LawyerCluehttps://lawyerclue.com
  LawyerClue offers expert legal insights, tips, and resources to help individuals and businesses navigate the complexities of the law.

Share this article

সাম্প্রতিক

জনপ্রিয় ক্যাটাগরি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent comments